১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ড্রেসিং রুম থেকে বাইরে বের হয়ে আসেন। তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি সেনাদের গুলি বন্ধ করতে বলেন।
তিনি জানতে চান, কেন তারা গুলি করছে? যদি তারা তাঁকে গুলি করতে চায় সেটা করুক, কেন তারা অন্য মানুষ এবং বাচ্চাদের ওপর গুলি করছে?
একজন মেজর পেছন থেকে গর্জন করে ওঠে গুলি বন্ধ করতে বলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে জানান, তাঁকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। এর ৩ দিন পর তাঁকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতারের আগেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সনদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। গ্রেফতারের ঘণ্টাখানেক আগে বঙ্গবন্ধু টেলিগ্রামে স্বাধীনতার বার্তা পাঠিয়েছিলেন।
ইংরেজিতে লেখা সেই ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছো এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে পাঠানো হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পুরো বাংলাদেশ এবং বিশে^ ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি সিডনি এইচ শ্যনবার্গকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখ রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি চট্টগ্রামে একটি গুপ্ত হেডকোয়ার্টারে ফোন করে স্বাধীনতার বার্তা পাঠিয়েছিলেন যেটা পরবর্তীতে গোপন ট্রান্সমিটার দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল।’
তৎকালীন ইস্ট-পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সুবেদার মেজর শওকত আলী পিলখানাতে অবস্থান করছিলেন। তিনি ছিলেন সিগন্যাল কোরে বাঙালিদের মধ্যে সিনিয়র। আজিমপুর গেটে প্রহরারত সৈনিকের মাধ্যমে রাত ১০টার কিছু পরে তার কাছে মেসেজ পৌঁছে যায়। তার সঙ্গে সে রাতে আরও দুয়েকজন ছিলেন। রাত সোয়া ১২টা বা তার কাছাকাছি কিছু সময় পরই ওয়্যারলেস মেসেজ ট্রান্সমিটাররত অবস্থায় তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা তাকে হত্যা করে। সুবেদার মেজর শওকত আলী ধরা পড়ার আগেই চট্টগ্রামে ইপিআরে বার্তা পৌঁছে দেন।
রাতে চট্টগ্রামে ইপিআরে সিগন্যালম্যান আবুল খায়ের ওয়ারলেসের সেট নিয়ে ডিউটিতে ছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে তিনি তার এসবিসি-৩ সেটে ভয়েস অপশন অফ করে রেখেছিলেন। রাত সাড়ে ১১টার কাছাকাছি তিনি তার সেটে টিজি (টেলিগ্রাফিক) অপশনে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি পান এবং মেসেজ আনকোড করে তৎকালীন কমান্ডার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামকে হস্তান্তর করেন। বীর উত্তম মেজর রফিকুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তাটি সঙ্গে সঙ্গে ডিসি, এসডিও, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছে দেন। এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়। এই বার্তা প্রেরণের পর বঙ্গবন্ধু আরেকটি লিখিত বার্তা সর্বত্র প্রেরণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু প্রেরিত দ্বিতীয় বার্তায় বলা হয়, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপস নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী লিখেছেন, ২৬ মার্চ সকাল ৯টায় আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হয়েছে বলে প্রচার করা হয়। এদিন অস্ট্রেলিয়ার বেতারে (এবিসি) ঢাকার গণহত্যার খবর প্রচরা করা হয়।
স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে পাকিস্তানের তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে লিখেছেন, ‘যখন প্রথম গুলিটি ছোড়া হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে ক্ষীণস্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হলো আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।’
ওয়্যারলেস বার্তায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ও দক্ষিণ এশিয়া করেসপনডেন্ট ডেভিড লোশাক লিখেছেন, ঘোষণাকারীর গলার আওয়াজ খুব ক্ষীণ ছিল। খুব সম্ভবত ঘোষণাটি আগেই রেকর্ড করা ছিল। ২৭ মার্চ ১৯৭১, শনিবার দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশনের হেডলাইন হয়েছিল ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা’।
ইংল্যান্ডের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য টাইমসে ২৭ মার্চের মূল শিরোনাম-‘হেভি ফাইটিং এজ শেখ মুজিবুর ডিক্লারস ইস্ট পাকিস্তান ইনডিপেনডেন্ট’। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাদেশিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে গৃহযুদ্ধের গর্জন। ‘দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের শিরোনাম ‘সিভিল ওয়ার আফটার ইস্ট পাকিস্তান ডিক্লারস ইনডিপেনডেন্ট’। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গতকাল শেখ মুজিবের স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে’।
দি নিউইয়র্ক টাইমসের ২৭ মার্চের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আজ পাকিস্তান রেডিও জানিয়েছে যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন ঘোষণা এবং ওই অঞ্চলের বিভিন্ন শহরে বিদ্রোহের কয়েক ঘণ্টা পর স্বাদেশিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে’।
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক পত্রিকা ‘দ্য এজ’ ২৭ মার্চে ‘ঢাক্কা ব্রেকস উইথ পাকিস্তান’ শিরোনামে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, আজ পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করেছে এবং শেখ মুজিব এই ঘোষণা দেন।
বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের সময়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় পাকিস্তানি ‘ডন’ পত্রিকার ২৮ মার্চ ১৯৭১ রোববারের সংখ্যায়। ‘আর্মি ইন ফুল কন্ট্রোল ইন ইস্ট পাকিস্তান, শেখ মুজিব অ্যারেস্টেড ফরম হিজ হাউস’ শিরোনামে বলা হয়, রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এ ছাড়া এই ঘৃণ্য ঘটনার একজন মূল পরিকল্পনাকারী রাও ফরমান আলী তার ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেট’ বইতেও শেখ মুজিবকে রাত ১টা ৩০ মিনিটে গ্রেফতারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
দৈনিক বাংলায় ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়। সেখানে তিনি বলেন, ‘রাত প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে ওরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে ওপরে উঠে এলো।’
ইপিআরের শহিদ সুবেদার মেজর শওকত আলীর কন্যা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেলিনা পারভিন একাধিক সাক্ষাৎকারে সেদিনের ঘটনার উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সুবেদার মেজর শওকত আলী যখন ট্রান্সমিট করছিলেন তখন তার সঙ্গে ছিলেন সিগন্যালম্যান আবদুল মোত্তালিব। যিনি সেই রাতে শওকত আলীর সঙ্গে গ্রেফতার হয়েও বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণা ট্রান্সমিশনে শওকত আলী ‘মোটোরোলা এসবিসি-৩’ সেট ব্যবহার করেন। এটি ইপিআর সিগন্যাল কোরে ব্ল্যাকসেট বলে জনপ্রিয়। সেটটিতে ভয়েস অপশন ও টিজি অপশন দুটোই রয়েছে।
জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ সময়ের আলো বলেন, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতির জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর নির্বাচন, ১৯৫৮-তে আইয়ুবের মার্শাল ল, ১৯৬৬-তে ছয় দফা, ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুবের পতন, ১৯৭০-এর নির্বাচন পেরিয়ে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানি কমান্ডাররা গ্রেফতারের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু গবেষক অধ্যাপক হারুন বলেন, সবাই ভেবেছিল ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কিন্তু সেদিন ঘোষণা দিলে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে প্রচার করা হতো। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট প্রোগ্রামের নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালিকে হত্যা শুরু করে। গণহত্যা চালায়। টেলিগ্রামের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’
তিনি বলেন, বর্তমান বিজিবি তৎকালীন ইপিআরের নায়েব মেজর শওকত আলীর ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধু বার্তা পাঠান। শওকত আলী চট্টগ্রামে ইপিআরসহ সব ইপিআর দফতরে বার্তা পাঠান। চট্টগ্রামে মেজর রফিকুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সঙ্গে সঙ্গে ডিসি, এসডিও, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে বার্তাটি পাঠিয়ে দেন।
তিনি বলেন, এটি হঠাৎ কোনো ঘোষণা নয়, পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সেলিম সময়ের আলোকে বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণেই স্বাধীনতার ঘোষণা ও দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেননি। তা হলে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী, বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রচার করত। এতে করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিলম্বিত হতো। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পূর্বে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
খবর: সময়ের আলো