মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু এখন আতঙ্কের নাম। এ বছর ডেঙ্গুতে ১৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। এর আগে ২০১৯ সালে এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড ছিল ১৭৯ জনের। বছরের শেষদিকে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রাণঘাতী রূপে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু।
এ পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ শিশু। ডেঙ্গুতে যত মানুষ মারা গেছে তার ৩৫ শতাংশই শিশু। এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে সিয়ামের মতো অনেক শিশুর মৃত্যুর খবর আসছে। ছোট্ট শিশুদের হারিয়ে পরিবারে শোকের মাতম বাড়ছে।
চলতি বছরের শুরু থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত মারা যাওয়া ১২০ জন ডেঙ্গু রোগীর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, চলতি বছর মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশই শিশু। এর মধ্যে এক থেকে চার বছর বয়সি শিশু মৃত্যুর হার ছয় শতাংশ। পাঁচ থেকে ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুর হার ১০ শতাংশ। ১০-১৮ বছর বয়সি শিশু মৃত্যুর হার ১৯ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ১৯-২৯ বছরের রোগীদের। এসব রোগীর মৃত্যুর হার ২৮ শতাংশ। ঢাকার ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ২০ জনের। দ্বিতীয় শীর্ষ মৃত্যুতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ১৯ জন এবং এরপরেই বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
চলতি নভেম্বর মাসের মাত্র ১১ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আট হাজার ৪৬২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর ৫১ জন মারা গেছে। এ বছর মশাবাহিত এই রোগের প্রকোপে হাসপাতালে প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগী ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে। হাসপাতালে যে পরিমাণ রোগী আসছে, সম্ভব হচ্ছে না তাদের ভর্তি করা। ঢাকার বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর রোগীর জন্য বরাদ্দ শয্যা ফাঁকা নেই। মুমূর্ষু রোগীদের জন্য আইসিইউ বা সিসিইউর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠছে। ২০১৯ সালের মতো ডেঙ্গু গুরুতর পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। দেশে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল কোভিড মহামারি হানা দেওয়ার ঠিক আগের বছর ২০১৯ সালে। সে বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল, মৃত্যু হয়েছিল ১৭৯ জনের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামাল দিতে না পারলে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের রেকর্ড ছাড়াবে।
কয়েকজন শিশু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিশুদের মারা যাওয়ার প্রথম কারণ ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম। ডেঙ্গুর হেমোরেজিক ফিভারের সঙ্গে সারকুলেটরি ফেইলিওর হলে তাকে ‘শক সিনড্রোম’ বলে। জ্বর হলে মানুষ প্রথমে মনে করে তা মৌসুমি। দুই-তিন দিন পর জ্বর সেরে যাওয়ার ২৪-৪৮ ঘণ্টা পর রোগী শক সিনড্রোমে চলে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীর প্লাটিলেট কমে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। এরপর কিডনি, লিভার ও হার্ট বিকল হয়ে রোগী মারা যায়।
চিকিৎসকের ভাষায়, এই চারটি সমস্যাকে একসঙ্গে বলা হয় মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম বা এমআইএসসি। এমআইএসসি আক্রান্ত শিশুর রক্তপ্রবাহ কমে যায়। এতে হার্ট, কিডনি, ফুসফুস ও যকৃতের মতো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গু রোগীদের পেট ও ফুসফুসে পানি আসছে। অনেকের প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তক্ষরণ হয়, বমি হয়। বেশিরভাগ রোগী দেরি করে হাসপাতালে আসায় শকে চলে যায়। ফলে তাদের আইসিইউ প্রয়োজন হয়। আইসিইউ খালি না থাকায় অনেক রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।