ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য শুরুর পর থেকে আরবি বছর হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী তারা কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সঙ্গে এর কোনো মিল পাওয়া যেত না। আর তখন সম্রাট আকবর এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য বাংলায় বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
সম্রাটের আদেশ অনুযায়ী সে সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌরবছর ও আরবি হিজরি সালের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরির কাজ শুরু করেন।
বাংলা বছর নির্ধারণ নিয়ে লেখা বাংলা সন গণনা পদ্ধতিকে কার্যকর ধরা হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের তারিখ থেকে। প্রথমে ফসলি সন বলা হলেও পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলা মাসের নামগুলো তারকারাজির নাম থেকে নেওয়া হয়েছে। যেমন বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পূষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফলগুনি থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র। আগেকার দিনে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শুরু হতো বলে এ মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। তাই এ মাসের নামই রাখা হয় অগ্রহায়ণ। অগ্র অর্থ প্রথম আর হায়ণ অর্থ বর্ষ বা ধান।
সম্রাট আকবরের সময়ে একটি বিষয় ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, তা হলো মাসের প্রতিটি দিনের জন্য আলাদা আলাদা নাম ছিল; যা প্রজাসাধারণের মনে রাখা খুবই কষ্ট হতো। তাই সম্রাট শাহজাহান সাত দিনে সপ্তাহভিত্তিক বাংলায় দিনের নামকরণের কাজ শুরু করেন। ইংরেজি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় কিছুটা ইংরেজি সাত দিনের নামের আদলে বাংলায় সাত দিনের নামকরণ করা হয়। যেমন, সানডে- রবিবার। সান অর্থ রবি বা সূর্য আর ডে অর্থ দিন। এভাবে বর্ষ গণনার রীতিকে বাংলায় প্রবর্তনের সংস্কার শুরু হয় মোগল আমলে।
তখনকার দিনে শুধু কৃষিকাজ করার তাৎপর্যকে ধারণ করেই বাংলায় বছর গণনার রীতি চালু হয়। কিন্তু বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাঙালিদের যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখার সুবিধার্থে বাংলাদেশের সব জায়গাতেই খ্রিস্টীয় সন ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল নববর্ষ পালিত হয়। বাংলা দিনপঞ্জির সঙ্গে হিজরি ও খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। তা হলো হিজরি সন চলে চাঁদের সঙ্গে আর খ্রিস্টীয় সাল চলে ঘড়ির সঙ্গে। এ কারণে হিজরি সনের নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনের মধ্য দিয়ে, ইংরেজি দিন শুরু হয় মধ্যরাতে আর বাংলা সনের শুরু হয় ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে।
আধুনিক নববর্ষ পালনের তত্ত্ব তালাশ করতে গিয়ে জানা গেল ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তন ও পূজার আয়োজন করা হয়েছিল। এরপর ১৯৩৮ সালে একইভাবে ভালো কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয় নববর্ষ পালনের জন্য। মোদ্দাকথা ১৯৬৭ সালের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়নি। এরপর থেকে প্রতি বছরই বাড়তে থাকে পহেলা বৈশাখ বরণের সাড়ম্বরতা।
বাংলা শুভ নববর্ষ পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শুভ নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সঙ্গে পালন করা হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেয়। সে হিসাবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। বিশ্বের সব প্রান্তের সব বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে অতীত বছরের সব দুঃখ-গ্লানি।
সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখময় হয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা একে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ এপ্রিল অথবা ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়। আধুনিক বা প্রাচীন যেকোনো পঞ্জিকাতেই এই বিষয়ে মিল রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমি নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এদিন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
বাংলা দিনপঞ্জির সঙ্গে হিজরি ও খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরি সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সন ঘড়ির হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরি সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে। ইংরেজি দিন শুর হয় মধ্যরাতে। পহেলা বৈশাখ রাত ১২টা থেকে শুরু না সূর্যোদয় থেকে শুরু। এটা নিয়ে অনেকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে, ঐতিহ্যগতভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমি এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু হয়।
বাংলা ১২টি মাস অনেক আগে থেকেই পালন করা হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, ওড়িশা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালন করা হতো। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন বাংলা শুভ নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালন করা হতো। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর ওপরই নির্ভর করতে হতো।
আকবরের শাসনামল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে।
তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা- সব স্থানেই পুরোনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি।
পহেলা বৈশাখ ঘিরে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর। পাকিস্তান তৈরি হওয়ার পরপরই পাঞ্জাবি প্রশাসন নানাভাবে বাঙালিদের নিগৃহীত করতে থাকে। চালায় উর্দু আগ্রাসন। চেষ্টা চলে সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের। এ সময় বাঙালিরা আরও গভীরভাবে তাদের শিকড়ের টান অনুভব করে। শুরু হয় পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পহেলা বৈশাখ পালনের স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজন। তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সরকারিভাবে প্রথম পহেলা বৈশাখ উদযাপন হয় ১৯৫৪ সালে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলার এ কে ফজলুল হক প্রথম পহেলা বৈশাখে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তারপর সামরিক শাসন জারিসহ পাকিস্তানি প্রশাসনের আগ্রাসী নীতির কারণে সরকারিভাবে আর পহেলা বৈশাখ পালন হয়নি।
পহেলা বৈশাখ নিয়ে নতুন করে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে। ১৯৬১ সালে রবি ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। এ ছাড়া পাঞ্জাবিরা ‘হিন্দু’ রবীন্দ্রনাথের গানকে রীতিমতো বিজাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য করতে থাকে। এমনই বাস্তবতায় সামনে এগিয়ে আসে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। শুরু হয় অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে পহেলা বৈশাখে গানের অনুষ্ঠান আয়োজন। বৈশাখে ছায়ানটের প্রথম অনুষ্ঠান হয় বলধা গার্ডেনে। এরপর তা স্থানান্তর করা হয় রমনার বটমূলে। এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুন, কামাল লোহানী আর সবার ওপরে ছায়ার মতো ছিলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন কবি বেগম সুফিয়া কামাল।
রমনার বটমূলে ছায়ানটের প্রথম বর্ষবরণের গানের অনুষ্ঠান হয় ১৯৬৭ সালে। সেই সময় অশ্বত্থ (যাকে আমরা বট গাছ বলে থাকি) গাছ থেকে শুয়োপোকা ঝরে পড়ত। অনেক জঙ্গলে ঘেরা সেই জায়গায় তেমন মানুষ চলাচল করত না। তবে সেই অনুষ্ঠানে ছিল মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ। সামরিক শাসকদের চোখ রাঙানির তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার অনাবিল আনন্দ। সেই সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হতো সকাল ৬টায়। যে ঐতিহ্য আজও বজায় রেখেছে ছায়ানট।
বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো পান্তা-ইলিশ। যেন এ পান্তা-ইলিশ না হলে আর পহেলা বৈশাখের কোনো আমেজই থাকে না। বেশ তো এ সুযোগে রমনার লেকের পারেই অনেকে বসে পড়েন ইলিশ-পান্তা খেতে। সঙ্গে থাকে কাঁচামরিচ। মানে সম্পূর্ণভাবেই বাঙালিয়ানার পরিচয় দিতে ব্যস্ত থাকে সবাই।
বর্ষবরণের অনুষ্ঠানমালায় ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৮৯ সালে এ শোভাযাত্রার প্রচলন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। পহেলা বৈশাখের দিন সকাল গড়িয়ে যখন রমনা টিএসসি শাহবাগে মানুষের উপচে পড়া ভিড় জমে, তখন শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।