রংপুর চিনিকল। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জে অবস্থিত গাইবান্ধার একমাত্র কৃষিভিত্তিক ভারী কারখানা এটি। লোকসান কমাতে আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার কথা বলে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বন্ধ করে দেওয়া হয় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ছয়টি চিনিকল। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার এ সিদ্ধান্তের খড়গ পড়ে দেশের সর্বোচ্চ মাড়াইক্ষমতার এ চিনিকলটির ওপরেও।
এদিকে দুই বছর ধরে বন্ধ থাকায় জঙ্গলে ভরে গেছে ৩৫ একর আয়তনের কারখানার চত্বরটি। খোলা আকাশের নিচে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা আখ পরিবহনের যানবাহনগুলো এখন ধ্বংসের পথে। কারখানার ভেতরের দৃশ্যটাও একই রকম। মরিচার দখলে এখন শত কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি। থমকে আছে জীবিকার চাকাগুলো। আখচাষি আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিত্যদিনের সমাবেশের চিরচেনা দৃশ্য আর নেই। হাজারো মানুষের একসময়ের জীবন-জীবিকার কেন্দ্রস্থলের প্রবেশপথ ও মিলে আখ সরবরাহের জন্য শত শত সারিবদ্ধ গাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণটি এখন গোচারণভূমি।
জানা যায়, ১৯৫৪ সালে তৎকালীন রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহুকুমার গোবিন্দগঞ্জ থানাধীন মহিমাগঞ্জে শুরু হয় রংপুর চিনিকলের নির্মাণকাজ। সে সময়কার ২৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছরে শেষ হয় মিলটির নির্মাণকাজ। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুম থেকেই আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে চিনি উৎপাদন শুরু হয় মিলটিতে। পশ্চিম জার্মানির বাকাউ-উলফ নামের একটি কোম্পানি থেকে আনা মেশিনে ৩৫ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠে মিলের কারখানা ও কার্যালয়। ১৯৭২ সালে রংপুর চিনিকলসহ সব চিনিকলকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব¡ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
চিনিকলের কর্মকর্তাদের জন্য গড়ে তোলা হয় আবাসিক স্থাপনা। পুকুরসহ রেলওয়ে সাইডিংয়ের জায়গা আট একর। সাড়ে ১৪ একর জায়গায় গড়ে ওঠে ৫০টি ইক্ষু ক্রয়কেন্দ্র এবং আটটি সাব-জোন। এ ছাড়াও মিলের নিজস্ব খামারের জমির পরিমাণ এক হাজার ৮৩২ একর। ১৯৫৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৩ বছরে ২২ হাজার ৯৮৫ দিনের মধ্যে পাঁচ হাজার ৭৩৯ দিন ঘোরে মিলের চাকা। আর এ সময়কালে ৫৬ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে উৎপাদন করা হয় চার লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন চিনি। শুধু তাই নয়, রংপুর চিনিকলের ছিল নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা।
এখানকার পাওয়ার হাউসে উৎপাদিত বিদ্যুৎ রেলস্টেশনসহ সরবরাহ করা হতো উপজেলার বিভিন্ন জায়গায়। চিনিকলের আখ পরিবহনের জন্য ছিল নিজস্ব রেলপথ। সেই রেলপথে নিজস্ব রেলের ইঞ্জিন ও মালবাহী বগি দিয়ে পরিবহন করা হতো আখ, চিনি, চিটাগুড় ও জ্বালানিসহ নানা দ্রব্য। চিনির কলটিকে ঘিরে জাঁকজমক ছিল মহিমাগঞ্জ রেলস্টেশন। সেই সুবাদে বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠে মহিমাগঞ্জ। জেলার শিক্ষার প্রসারেও অনন্য ভূমিকা রাখে রংপুর চিনিকল উচ্চ বিদ্যালয়। সবকিছু মিলিয়ে চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষিসহ অসংখ্য মানুষের আয়-রোজগারের পথ সৃষ্টি করেছিল ঐতিহ্যবাহী এ কারখানাটি।
অথচ আধুনিকায়নের নাম করে দুই বছর আগে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয় গাইবান্ধার লক্ষাধিক মানুষের আয়ের পথটাকে। সে সময় বার্ষিক আখ মাড়াই মৌসুম শুরুর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ও বিপুল পরিমাণ পরিপক্ব আখ জমিতে রেখে একেবারে শেষ মুহূর্তে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিক্ষুব্ধ আখচাষি ও শ্রমিক-কর্মচারীরা শুরু করেন ব্যাপক আন্দোলন। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলন ও চাষদের করুণ আকুতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় মাড়াই কার্যক্রম।
শ্রমিক-কর্মচারী ও চাষিরা বলেন, তখন আন্দোলনরত শ্রমিক-কর্মচারী ও চাষিদের উদ্দেশ্যে দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানান হয়েছিল, আধুনিকায়নের মাধ্যমে খুব দ্রুতই আবার চালু করা হবে এ চিনিকলসহ সব চিনিকল। কিন্তু প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা এবং ৫০ হাজার চাষি ছাড়াও বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত লক্ষাধিক মানুষের জীবিকার দায় মেটানো এ রংপুর চিনিকলটি চালু হয়নি দুই বছরেও। বরং এ চিনিকলের স্থায়ী চাকরিজীবীদের একাংশ, গাড়ি, যন্ত্রাংশ ও নানা প্রয়োজনীয় মালামাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এখান থেকে অন্যত্র।
কাজ হারানো চুক্তিভিত্তিক অর্ধসহস্রাধিক শ্রমিক এখন পেটের দায়ে ভ্যান-রিকশা চালনাসহ বিভিন্ন কাজ করে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে চালু রাখা পার্শ্ববর্তী চিনিকলের চেয়ে অধিক মাড়াই ক্ষমতাসম্পন্ন ও অধিক পরিমাণ আখ উৎপাদিত হলেও রহস্যজনক কারণে এ কলটি বন্ধ করায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন এলাকার হাজার হাজার আখচাষিসহ সাধারণ মানুষ।
চিনিকল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ৯০-এর দশকে তৎকালীন এরশাদ সরকারের আমলে আধুনিকায়নের নামে কর্মকর্তাদের জন্য দামি গাড়ি-বাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ও কারখানার কিছু সংস্কারের জন্য বিশ্ব ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার আওতাধীন চিনিকলগুলোকে। ওই ঋণই এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিনিকলগুলোর জন্য। রংপুর চিনিকলের বর্তমানে ৫০০ কোটি টাকা পুঞ্জীভূত লোকসানের প্রধান কারণ বিশ্ব ব্যাংকের এই ঋণ।
রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূরুল কবির জানান, চালু অবস্থায় এ চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের জন্য বেতনভাতা বাবদ মাসে প্রায় এক কোটি টাকা প্রয়োজন হতো। সরকারি সিদ্ধান্তে মাড়াই বন্ধ হওয়া এ চিনিকলের বিপুল পরিমাণ সম্পদ রক্ষায় বর্তমানে ২৬ জন স্থায়ী কর্মকর্তা ও ৬২ জন অস্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারীর বেতনভাতায় খরচ হয় ২০ লাখ টাকা।
রংপুর চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক ফারুক হোসেন ফটু জানান, দেশের কৃষক-শ্রমিকদের স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্প বন্ধ করে দেওয়ার গভীর চক্রান্ত চলছে। চিনিকলটি বন্ধ হয়ে থাকায় অর্থনৈতিকসহ এ জনপদের সব স্তরে অন্ধকার নেমে এসেছে।